ডঃ সেন- জীবন্ত ভগবান
– রাণা চ্যাটার্জী
“দেখুন ম্যাডাম আপনাকে বহুবার বলেছি আপনার ছেলের শরীরের কন্ডিশন ভীষণ খারাপ, icu তে আছে, ওভাবে প্রত্যেক ঘন্টায় ‘কেমন আছে’ জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করবেন না, বাইরে বসুন।”
মৃদু ধমক খেয়ে নিজেকে সামলাতে পারল না রজনী, হাপুস নয়নে কেঁদে ফেললো। রাত জাগা ক্লান্ত ক্ষীণ শরীরে সুপার স্পেশালিটি হসপিটালের বাইরে সারারাত প্রতীক্ষার প্রহর গুনেছে মা। কত কি যে বাজে স্বপ্ন এসেছে সঙ্গে তন্ময়ের শৈশব, হামাগুড়ি, অন্নপ্রাশন, স্কুল যাওয়া সব ভিড় করে আসছিল জলের ধারায়।
কাল সন্ধ্যায় বাড়ির সামনের ঠেকে অন্য দিনের মতোই আড্ডা দিচ্ছিল তন্ময়। সেই পুরনো অভ্যাসে বাইক স্ট্যান্ড করে তাতে বসে ঘন্টাখানেক আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফেরে।সন্ধ্যা নামলেই সুনসান শহর রাস্তা ঘাট কিন্তু কাল আচমকা সবাইকে চমকে পাথর বোঝাই ভারী ট্রাক এসে ব্রেক ফেলে ধাক্কা মারে সরাসরি। অল্পের জন্য বাকিরা বাঁচলেও ছিটকে পড়ে তন্ময়, মাথা ফেটে রক্তপাত।বন্ধুরা ঘাবড়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনলে ব্যান্ডেজ চিকিৎসা, বাড়ি পৌঁছে দিয়ে স্বস্তি। দু’বছর আগে স্বামী হারিয়ে সময়ের গর্ভে তলিয়ে যাওয়া পরিবারটা যখন সন্তানের মুখ চেয়ে দাঁড় করাচ্ছিলো রজনী, আচমকা দুঃসময়ের কড়া নাড়া!
“একি রে রক্ত যে থামছে না, বালিশ ভিজে চুঁইয়ে”-কেঁপে উঠল মা। কাল বিলম্ব না করে পাড়ার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে হাজির হলো চল্লিশ কিমি দূরে একমাত্র ভরসার বড় হসপিটালে।ভর্তি করিয়ে অপেক্ষার রাত জাগরণ এই বুঝি সুস্থতার খবর, কিন্তু কোথায় কি!
কে যেন একজন হেঁটে আসছেন করিডোর দিয়ে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সাদা ড্রেস দীর্ঘ বলিষ্ঠ, হাতে স্টেথো! পাশে দু-চার জন নার্স, ওয়ার্ড বয়, গাড়ির ড্রাইভার ব্যাগ হাতে উদ্বিগ্ন।ম্যানেজার দৌড়ে এসে বললেন, “স্যর এমন মর্মান্তিক গাড়ি দুর্ঘটনায় আপনার সন্তানের আজ ভোরে স্পট ডেথের খবরে আমরা ব্যথিত, মর্মাহত, জাস্ট ভাবতে পারছি না স্যর। কদিন বাড়িতেই থাকুন স্যর, আমরা সামলে নেব”।
এই হসপিটালের জীবন্ত ভগবান ডক্টর সেনের ছেলে দুর্ঘটনায় মৃত-ছড়িয়ে পড়ল খবর। অভাগী মা হাতজোড়ে সামনে চলে আসতেই থমকালেন ডাক্তার বাবু। খবর নিয়ে জানলেন রাতে ভর্তি হওয়া এনার ছেলের অপারেশন তিনিই আজ সকালে করতেন, দুর্ঘটনার খবর কেউ জানাতে সাহস করে নি। বিরক্ত মুখে গতিমুখ পাল্টে ভেতরে গেলেন। ওই ভেঙে পড়া মা’কে ভেতরে বসানোর নির্দেশ দিয়ে দেড় ঘন্টার অপারেশনে সফল হয়ে বেরিয়ে এলেন।বললেন “মা আপনার সন্তান দীর্ঘজীবী হোক!” চোখের কোল দুটো ডক্টর সেনের অশ্রু বিন্দুতে ভিজেছে এক সন্তান বাঁচিয়ে নিশ্চয় মনে পড়ছে নিজের ছেলের মুখটা।